চবিতে ৭ম এ. কে. খান মেমোরিয়াল ল লেকচার অনুষ্ঠিত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ ও এ. কে. খান ফাউন্ডেশনের যৌথ আয়োজনে রবিবার (৪ মে ২০২৫) সকাল ১০:৩০টায় চবি আইন অনুষদের এ. কে. খান অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হলো ‘৭ম এ. কে. খান মেমোরিয়াল ল লেকচার ২০২৫’।
 
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। বক্তব্যের শুরুতে তিনি তাঁর নানা, তৎকালীন ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম-এর সঙ্গে প্রয়াত এ. কে. খানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং একসঙ্গে কাজ করার স্মৃতি স্মরণ করেন। তিনি বলেন, এ. কে. খান ছিলেন একজন প্রজ্ঞাবান, দূরদর্শী ও নীতিনিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, যিনি ন্যায়ের প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন।
মাননীয় প্রধান বিচারপতি তাঁর “Reimagining the Future of Justice” শীর্ষক মূল বক্তৃতায় বিচার বিভাগের বর্তমান অবস্থা, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা ও বিচার সংস্কার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান সাংবিধানিক বাস্তবতায় বিচার বিভাগই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে।
 
তিনি আরও বলেন, ২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ঘোষিত ‘বিচার বিভাগীয় সংস্কার রোডম্যাপ’-এর আওতায় ইতোমধ্যে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হয়েছে। নির্বাহী ও আইনসভার প্রভাবমুক্ত দুটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান—Supreme Judicial Appointment Council এবং Supreme Judicial Council—গঠিত হয়েছে, যা বিচারকদের নিয়োগ ও অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
 
তিনি আরও জানান, সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি আলাদা বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। বিচারকদের বদলি ও পদায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একটি নীতিমালা সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে। বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে ১২ দফা দুর্নীতি দমন নির্দেশনা, দুটি হেল্পলাইন সেবা, পেপার-ফ্রি কোম্পানি বেঞ্চ, ডিজিটাল রিকুইজিশন সিস্টেম ও কেস ট্র্যাকিং ড্যাশবোর্ড চালু করা হয়েছে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত থাকা বিচারকদের ব্যক্তিগত তথ্যপত্র (PDS) হালনাগাদের কাজও শুরু হয়েছে।
বিচার প্রক্রিয়াকে আরও জনবান্ধব করতে শিশু, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য বিষয়ে বিশেষায়িত আদালত প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে। জেলা পর্যায়ে বাণিজ্যিক আদালত স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা ব্যবসায়িক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তিতে সহায়ক হবে। প্রধান বিচারপতি বলেন, এসব উদ্যোগ বিচ্ছিন্ন নয়, বরং বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় একটি বৃহৎ সাংবিধানিক নবজাগরণের অংশ। তিনি আরও বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া কোনো খাতেই স্থায়ী সংস্কার সম্ভব নয়।
 
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার মাননীয় প্রধান বিচারপতি, আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ, এ. কে. খান পরিবারের সদস্য, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অন্যান্য অতিথিদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানান। তিনি বলেন, এ আয়োজন শিক্ষার্থীদের চিন্তার পরিসর বাড়াবে এবং বিচারব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধিতে সহায়ক হবে।
 
তিনি আরও বলেন, “Reimagining the Future of Justice” শুধু একটি বক্তৃতার বিষয় নয়—এটি আমাদের চিন্তা, গবেষণা ও নীতিনির্ধারণের দিগন্ত উন্মোচনের সম্ভাবনা। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আমাদের কাজ শুধুমাত্র আইনের ব্যাখ্যা শেখানো নয়, বরং এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা, যা ভবিষ্যতের সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ দেখাবে। আমরা চাই, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা ভবিষ্যতে শুধু সফল পেশাজীবীই নয়, বরং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করুক।
 
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন চবি উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন, এ. কে. খান ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি সচিব সালাউদ্দিন কাশেম খান এবং ট্রাস্টি এ. এম. জিয়াউদ্দিন খান। অনুষ্ঠানে প্রয়াত এ. কে. খানের পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
 
উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) বলেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের এমনভাবে প্রস্তুত করা, যাতে তারা ভবিষ্যতের জটিল সামাজিক বাস্তবতায় ন্যায়বিচারের পথনির্দেশক হতে পারে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের কারিকুলাম, গবেষণা ও পাঠদানের ধরনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনার চেষ্টা করছি। একাডেমিক চর্চা শুধুই বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, তা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, বিচার ও ন্যায়ের ভবিষ্যৎ তৈরি হবে আজকের শ্রেণিকক্ষে।
বিশেষ অতিথি উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) মাননীয় প্রধান বিচারপতি, এ. কে. খান পরিবার ও আমন্ত্রিত অতিথিদের চবি ক্যাম্পাসে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানান। তিনি বলেন, প্রশাসন বিভাগের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নতুন কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গির দাবি রাখে। ন্যায়বিচারের অর্থ শুধু আদালতের রায় নয়—সেবা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা—এ সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সর্বদা চেষ্টা করছে যাতে প্রতিটি প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ, প্রযুক্তি-সহায়ক ও শিক্ষার্থীবান্ধব হয়। এই নীতিগুলো ভবিষ্যতের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তিনি বলেন, আমরা চাই শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক কাঠামো থেকেই ন্যায় ও দায়িত্ববোধের শিক্ষা পাক।
 
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন আইন বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. রকিবা নবী এবং এ. কে. খানের জীবনী পাঠ করেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ শাহীন চৌধুরী। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক ড. আসমা বিনতে শফিক ও সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আহসান খালিদ। সভাপতিত্ব করেন আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এম. জাফর উল্লাহ তালুকদার।
 
উল্লেখ্য, প্রয়াত এ. কে. খান (আবুল কাশেম খান) ছিলেন একজন প্রখ্যাত শিল্পপতি, শিক্ষানুরাগী ও জনহিতৈষী ব্যক্তিত্ব। ১৯৩৫ সালে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মুনসেফ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৪ সালে তিনি পদত্যাগ করে ব্যবসা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ভারত ভাগের পর তিনি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত শিল্প, পূর্ত, সেচ, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে তিনি ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন এ. কে. খান কোম্পানি, যা পরবর্তীতে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বহু সামাজিক ও শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান।
 
অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধান বিচারপতি, মাননীয় উপাচার্য, উপ-উপাচার্যদ্বয়, এ. কে. খান ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি সচিব, ট্রাস্টি ও অন্যান্য অতিথিদেরকে সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।
Scroll to Top